‘ঘোড়ার জীন মাটিতে লাগে না, রাজাবাবুকে চড়ে বসলেই হোল’ অথবা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয় কীভাবে? 


একটি প্রবাদ শুনেছিলাম এরকম: ‘ঘোড়ার জিন মাটিতে লাগে না, রাজাবাবুকে চড়ে বসলেই হোল’। বাক্যটির পশ্চাতে সামন্ত ব্যবস্থার প্রতি একটা কটাক্ষ আছে‌। রাজার শরীর আর তার বাহনের উপর স্থাপিত আসনের সঙ্গে মাটির কোনো যোগ নেই। প্রজাদের সঙ্গে ধরাছোঁয়া নেই। আমাদের মত দেশে যেখানে আমরা পশ্চাদপদ সামন্ত সম্পর্কগুলোকে রাজনৈতিকভাবে লড়ে বিনাশ করি নি সেখানে ঔপনিবেশিক শক্তি সরে যাবার পর তার গাঁথুনির উপর ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র হিসাবে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটাও সেই রকম : ‘ঘোরার জীন মাটিতে লাগে না, রাজাবাবুকে চোড়ে বসলেই হোল’।

সেই সামন্ত উপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় একদিকে আমাদের দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিপীড়নের সকল রাষ্ট্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। আর অপরদিকে আরও মজবুত হয়েছে গণবিচ্ছিন্ন আমলাতন্ত্র‌ এই ধরনের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামন্তীয় পশ্চাৎপদতা আরো বেশি নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে যখন দেখা যায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হচ্ছে অস্ত্র, জনগণের ইচ্ছা নয়। ফলে জনগণের কাছে কোন কিছুতে জবাবদিহিতায় বাধ্য নয় সে। এখন এহেন রাষ্ট্রে আসীন হবার জন্য কেউ গণতন্ত্রের বগাড়ম্বর‌ করেই আসুক কিম্বা না করেই এর ঘাড়ে চাপলেই আর মাটিতে পা ফেলার প্রয়োজন পড়ে না। যখনই কোন সরকার এ রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপে সে সরকার‌ই এই রাষ্ট্রের চরিত্রের কারণে জনগণের ইচ্ছা ও জবাবদিহির প্রক্রিয়া থেকে অনায়াসেই স্বাধীন থাকতে পারে। এ এক অদ্ভুত বাহন, একবার চড়ে বসলে জনগণের গায়ে আর গা লাগার সম্ভাবনা থাকে না। সশস্ত্রতা ও আমলাবাজিতায় আড়মোড়া বাঁধা এ ধরনের রাষ্ট্রকেই এক কথায় বলা যায় সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের বিরোধী রাজনীতির লক্ষ্য এই রাষ্ট্রটির‌ই ঘাড়ে চেপে বসা‌। কারণ: ‘ঘোড়ার জীন মাটিতে লাগে না, রাজাবাবুকে একবার চেপে বসলেই হোল’।

আমরা এখনো সামন্ত রয়ে গেছি এ ধরনের ইঙ্গিত উপরের কথাগুলোতে অন্তর্নিহিত থাকায় অনেকে আমার সঙ্গে গোস্বা করে অহেতুক তাত্ত্বিক বিতর্ক জুড়ে দিবেন। আমি কূটতর্কে না গিয়ে খালি সবাইকে বুকে হাত দিয়ে একটা উত্তর খুঁজতে বলি। একাত্তর সালে আমরা তো পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই লড়েছিলাম এবং তাদের পরাস্ত করেছিলাম। [যদিও ব্রেকেটে বলে রাখা দরকার সেটা করেছিলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায়] তাহলে আমরা কি করে ঠিক সেই পাকিস্তানি আমলের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকেই কার্বন কপি করে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে অতি দ্রুত পারদর্শিতায় খাড়া করলাম? আর এখন এরশাদ সাহেব যখন তাঁর দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে আমাদের কুকুর বেড়ালের মত মারছে তখন আমরা আবার লাশের রাজনীতিতে মেতে উঠেছি! পুরোটা কি এরশাদ সাহেবের দোষ? আয়নায় নিজেদের দেখলে আমরা দেখব— আমাদের সবার চেহারা এক রকম। আর সেই ঘোড়ায় রাজাবাবুর মতো, আমরা প্রত্যেকেই উঠে বসতে চাই সেই আসনে যার জিন মাটিতে লাগে না।

গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে এই রাষ্ট্রের প্রশ্নটাই মুখ্য। এই সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমরা টিকিয়ে রাখবো কি রাখবো না সেটাই হচ্ছে রাজনীতির প্রধান বিচার্য বিষয়। আর এই প্রশ্নেই সমাজ মোটামুটি দুটো শ্রেণীতে ভাগ হয়ে আছে। এক শ্রেণি চায়, পুরনো ব্যবস্থাটাই টিকে থাকুক, কেবল ক্ষমতার হাত বদল ঘটুক। এরশাদের বদলে আসুক বেগম খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেমন আছে তেমন রেখে বুঝিবা একটা ইলেকশান দিলেই বাংলাদেশের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই শ্রেণি আমাদের সকল মৌলিক প্রশ্ন অনবরত ভোটের প্রশ্নে রূপান্তরিত করে ফেলে। যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ওস্তাদ তারা নিদেন পক্ষে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হলেও খুশি। কারণ জংলি কচু ময়লায় আর নর্দমার হাবিজাবির মধ্যে ফলে ভালো, যেমন সামরিক অভ্যুত্থান ও নৈরাজ্যের মধ্যে দারুন পেকে ওঠে ফ্যাসিবাদ।

বিরাজমান রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা সচেতন বা অচেতনভাবে আমাদের এরশাদ বিরোধী রাজনীতির প্রধান প্রবণতা হলেও আমার বিশ্বাস সংবেদনশীল ছাত্র সমাজের মধ্যে এটা আধিপত্যকারী প্রবণতা নয়। এ বিষয়ে সম্প্রতি অনেক তরুণ ছাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলায় তাদের উপর আমার বিশ্বাস আরো গাঢ় হয়েছে। তরুণদের সার কথা হোল বিরাজমান রাষ্ট্র টিকে থাকুক সেটা মোটেও ছাত্র সমাজ চায় না। একটা মৌলিক বদল ঘটুক— এই চাওয়াটাই ছাত্রদের প্রাণের কথা। এবং সত্যি বলতে কি, ১৯৮৩ সালে তাদের দশ দফার মধ্য দিয়ে মৌলিক বদলের আকাঙ্ক্ষাটাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। এবং এখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও অন্যান্য সংগঠনের মতামত সম্পৃক্ত করে একে আরো ব্যাপক গণভিত্তি দেয়া যাবে। এই লক্ষ্যেই ছাত্রনেতাদের দলগত সংযোগ এবং মূল রাজনৈতিক দলের দলীয় রাজনৈতিক অবস্থান ও স্বার্থে যাই থাকুক, ওপরের নিরন্তর চাপ উপেক্ষা করেও ছাত্রনেতারা পরস্পরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিতে উদগ্রীব। এবং রক্তের মধ্য দিয়ে এ ওর হাতটা যখন নিজের হাতের মধ্যে তারা পেয়েছেন চেপে ধরেছেন সঙ্গে সঙ্গে। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা, অথচ এই অবিশ্বাস্য কাজটাই ছাত্রসমাজ করে ফেলতে পেরেছেন। আন্দোলনে এটাই সবচেয়ে বড় ধরনের লাভ এবং স্পষ্ট অগ্রগতি। কিন্তু এই ঐক্য যথেষ্ট নয় যদি না সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদল ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান কি করে ঘটে, সেই প্রক্রিয়াটা সবার কাছে স্পষ্ট থাকে এবং আন্দোলনের অন্তর্নিহিত লজিক অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, সঠিক পদক্ষেপটা কি? সেটাই এ মুহূর্তে প্রধান বিবেচনা ও ভাবনাচিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। এ বিষয়ে 'খবর কাগজ'- এর পাঠকদের কাছে আমি আমার ভাবনা পেশ করে রাখতে চাইছি‌। বলে রাখা দরকার, ‘সঠিক’ পথের আমি একচেটিয়া বেপারি নই। বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক রূপান্তরের ইতিহাস এবং আমাদের দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমার যে ধারণা গড়ে উঠেছে আমি কেবল সেটাই ব্যক্ত করছি। পাঠকরা নিশ্চয়ই এর সমালোচনা ও পর্যালোচনা করবেন। আমি আমার বক্তব্য গুছিয়ে বলার জন্যে স্কুল বালকের মতো ক্রমিক সংখ্যায় বলবো:

এক: শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক হতেই হবে, নইলে আন্দোলন হবে না এই সকল সামন্তীয় ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনা ত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তির উপর নির্ভরশীলতা একটা পশ্চাৎপদ সামন্তীয় মানসিকতা। গণতন্ত্রে ব্যক্তি হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রের জন্য প্রতিটি ব্যক্তিকেই লড়তে হবে। নিজের সার্বভৌম ইচ্ছার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার কর্তব্য ব্যক্তিকেই সম্পন্ন করতে হবে। ওটা হাসিনা খালেদার উপর ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে আন্দোলন-হরতালের সময় ভিসিআর দেখবো, সেটা চলবে না। লক্ষ্য করা যায় এই নির্জীব-নিবীর্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীই ঐক্যের জন্য বড় বেশি হা-হুতাশ করে।

দুই: আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কোনোটির‌ই বিরাজমান সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় বদল ঘটানোর লক্ষ্য নেই। এটা তাদের রাজনীতি নয়। মোটা দাগে তারা যে-শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে ক্ষমতাসীন সরকার সেই একই শ্রেণিরই রক্ষক। ফলে সাধারণভাবে তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে এই রাষ্ট্র টিকে থাকুক সেটা জাতীয় পার্টি, সেনাবাহিনী এবং আমলারা যতোটুকু চায় আওয়ামীলীগ ও বিএনপিও দলীয়ভাবে ততটুকুই চায়। তত্ত্বটা এই দুটি দলের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা বোঝার জন্য জরুরী, তাদের নাকচ করে দেবার জন্যে নয়। বাস্তবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বুঝবার জন্য খোলা মন রাখা দরকার কারণ আন্দোলনে সবসময়ই নতুন মাত্রা ও নতুন উপাদান যুক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তদুপুরি দল যা চায় এবং দলের সমর্থকরা যে প্রত্যাশায় দলের পেছনে এসে কাতারবদ্ধ হয় তা এককথা নয়। বিত্তবান শ্রেণীর একটা অংশ যারা শিল্প কলকারখানার উদ্যোগ নিয়ে এই রাষ্ট্রের দ্বারে দ্বারে আমলাতান্ত্রিকতা ও অসহযোগিতায় পিষ্ট হচ্ছেন তাঁরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনটা বোঝেন, তেমনি বোঝেন নিম্নবিত্ত, শ্রমিক ও কৃষকদের একাংশ যারা নানা কারণে এইসব দলের সমর্থকে পরিণত হয়েছেন‌। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণআন্দোলনে দলকে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য এদের কাছ থেকে সবসময় একটা চাপ অব্যাহত থাকে। একে কাজে লাগানো দরকার।

তিন: গণতন্ত্রের জন্য ব্যক্তি ও নির্দলীয় উদ্যোগের সবচেয়ে সফল স্বতঃস্ফূর্ত ও চমৎকার সাংগঠনিক প্রকাশ হচ্ছে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা সংগ্রাম পরিষদ বা আন্দোলনের সংস্থাসমূহ‌। সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও গণসংগঠন রয়েছে ঠিকই তবে নীতিগতভাবে তারা তাদের মূল রাজনৈতিক দলকে নয় বরং তাদের গণসংগঠনের সদস্য ও সমর্থকদের প্রতিনিধিত্ব করছে। যাদের অনেকেই নির্দলীয় এবং গণসংগঠনের সদস্য হবার কারণে মূল দলের রাজনীতি তাদের সমর্থন করতে হবে এমন কোন কথা নেই‌। ফলে মূল রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও সুতোর টান থাকা সত্ত্বেও বলা যায় যে, সংগ্রাম পরিষদগুলো জনগণের নির্দলীয় সংস্থা, সে হিসাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিও বটে। বড়ো দলগুলোর লক্ষ্য ও শ্রেণীস্বার্থের সীমাবদ্ধতার জন্যে তাদের উপর নির্ভর না করে এই সকল সংস্থার একটা যৌথ সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলাটাই হবে আন্দোলনকে সামনে নিশ্চিত ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার সঠিক পদক্ষেপ। এর নির্দলীয় চরিত্রের জন্যে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী এই ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্থার প্রতি জনগণের আস্থা থাকবে বেশি এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যতো বেশি তা জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারবে ততোই একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিকল্প হয়ে উঠতে বাধ্য। বলা বাহুল্য আন্দোলনের এই নয়া নেতৃত্বদানকারী সংস্থার যে কোন নাম হতে পারে।

এই সার্বভৌম যৌথ সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার পদক্ষেপ না নিয়ে যতোবারই আন্দোলনের সংস্থাগুলো রাজনৈতিক জোটের অধীনস্থ হয়েছে ততোবারই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে এবং আন্দোলন বিভিন্ন দলের বিভেদ ও খেয়োখেয়ির শিকারে পরিণত হয়েছে।

চার: সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যকেই বিশেষভাবে যৌথ সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। কারণ আন্দোলনকে নতুনভাবে প্রাণ দেয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ যে সামাজিক রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে তার উপর দাঁড়িয়ে অন্যান্য আন্দোলনের সংস্থার সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সহজ।

পাঁচ: আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী যৌথ সংগ্রাম পরিষদের প্রাথমিক কাজ হবে যে-সকল গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া ইতিমধ্যেই সমাজের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের মধ্য দিয়ে উত্থিত হয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয় বিধান করা এবং আন্দোলনকারী যে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি তাদের প্রত্যাশা দফা বা দাবি আকারে পেশ করতে পারেনি তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের গণতন্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা সমন্বিত দাবি-দাওয়ার মধ্যে সম্পৃক্ত করা। এই কাজ করা তুলনামূলক ভাবে সহজ কিন্তু এটা অর্জনের মধ্য দিয়ে যৌথ সংগ্রাম পরিষদ তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সন্যায্যতা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারবে।

ছয়: সংগ্রামের নীতির দিক থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থার লক্ষ্য হতে হবে একটি— আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটানো, অন্য কোন ভাবে নয়। এই সরকারের কাছে 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি' অনেকটা শেয়ালের কাছে মুরগি ছানা চাওয়ার মতো ব্যাপার। এই অসম্ভব দাবি ত্যাগ করে আন্দোলনে মনোনিবেশ করতে হবে।

আন্দোলন পরিণত হয়ে ওঠার আগে যে সকল সম্ভাব্য প্রস্তুতি জনগণের নেয়া দরকার সে সকল বিষয়ে জনগণকে পরিষ্কার অবহিত রাখতে হবে এবং জনগণকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। নইলে আন্দোলন নৈরাজ্যের মধ্যে কিম্বা আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের গোলকধাঁধায় গিয়ে খাবি খাবে।

সাত: আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থা বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পরিণত হয়, এটাই হচ্ছে নিয়ম‌। আন্দোলনের নিজস্ব লজিক একে সেদিকেই নিয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই সংস্থা গণতন্ত্রকামী জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার অভিপ্রকাশ হয়ে ওঠে এবং একটি বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মর্মশাঁস হিশাবে আবির্ভূত হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করবার ব্যাপার নয়, হয়ে উঠবার ব্যাপার। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থায়ী বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়ে ওঠে।

আট: আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন হবার পর এবং এর ফলে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংস্থা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম কাজ হবে একটি সংবিধান সভা (Constituent Assembly) ডাকা। না, কোন 'সার্বভৌম সংসদ' বা 'গণপরিষদ' নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান করতে হবে একটি সংবিধান সভা যেখানে নবোদ্ভূত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হবে। বলা বাহুল্য সংবিধান সভার সদস্যরা অবশ্যই নির্বাচিত হবেন। সকল সাংবিধানিক বিতর্কের মীমাংসা হবে সেই সংবিধান সভায়‌। ৭২ সালের সংবিধান থাকবে কি থাকবে না, নাকি রাষ্ট্রের আরো বিকেন্দ্রীকৃত গণতান্ত্রিক রূপের জন্য জনগণ রায় দেবে, কিম্বা আমাদের সরকার পদ্ধতি প্রেসিডেন্সিয়াল হবে নাকি পার্লামেন্টারি হবে প্রভৃতি বিষয় নির্ধারিত হবে সেখানে। এখন এসব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তোলা হবে আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠন তো বটেই দেশের যেকোনো নাগরিকেরই অধিকার থাকবে আগামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান কেমন হবে সে সম্পর্কে নিজ নিজ মতামত পেশ ও প্রচারের। সংবিধান সভা ডাকার সময় ও সংবিধান সভার প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় জনগণকে পরিষ্কার জানাতে হবে যে এটি একটি সংবিধান সভার নির্বাচন, গণপরিষদের নয়। যাতে সংবিধান সভায় প্রতিনিধিত্ব করার মতো সঠিক ব্যক্তি জনগণ নির্বাচিত করতে পারে।

নয়: সংবিধান প্রণীত হবার পরপরই সংবিধান সভা ভেঙ্গে যাবে এবং সংবিধানের নির্দেশিত নিয়মে অবিলম্বে সংসদ বা গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম সংসদ বা গণপরিষদের সভার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করবে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন‌ও হবে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জন্ম দিতে হলে আন্দোলনকে মোটা দাগের এই পদক্ষেপগুলো অতিক্রম করে যেতে হবে। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করার ব্যাপার রয়েছে। যখন সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভাঙ্গার কথা যখন বলা হয় তখন অনেকে বেশ হতমতো খেয়ে যান রাষ্ট্র কি বোতল না বাদাম যে ভাঙ্গা যায়! 'ভাঙ্গা' মানে কি? রাষ্ট্রের উপর হাতুড়ি চালাতে হবে? আসলে রাষ্ট্র ভাঙ্গার ব্যাপারটা মোটেও ভাঙ্গাভঙ্গির ব্যাপার নয়। আসলে এর রহস্যটা নিহিত রয়েছে অন্তর্ভুক্তিকালীন সরকার কর্তৃক সংবিধান সভা ডাকার মধ্যে। নতুন সংবিধান রচনার মধ্য দিয়েই পুরনো রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয় বা ভেঙ্গে যায় আর উত্থিত হয় নতুন রাষ্ট্র‌।

কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণই যথেষ্ট নয় সংবিধান রচনার সময় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্মশাঁস বজায় রাখবার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া না হলে পুরনো কাঠামোই আবার নতুন করে পেতে হবে আমাদের। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যবস্থা রেখে রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে একটা কাজের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে সেনাবাহিনী আমলা পুলিশ প্রভৃতির ভূমিকা কি হবে নতুন রাষ্ট্রে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কি এখনকার মতো একটা স্থায়ী সেনাকাঠামো রাখা হবে নাকি সকল জনগণের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণটাই হবে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক! সেনাবাহিনী থাকবে না তা নয়, সমগ্র জনগণই হবে সেনাবাহিনী। অপরদিকে পুলিশ আমলা ইত্যাদিকে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থাসমূহের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য রাখার মত ব্যবস্থা থাকতে হবে। আসলে বর্তমানে যে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো আছে তাকে মূলসুদ্ধ উপড়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে আমাদের। আন্দোলন চালিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই সকল বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

৪ কার্তিক ১৩৯৭।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।